স্বরাজ ইন্ডিয়া রাষ্ট্রীয় অধ্যক্ষ যোগেন্দ্র যাদবের প্রতিবেদন: ভোট হোক ইভিএমেই, প্রয়োজন শুধু বাড়তি সতর্কতার

ভোট হোক ইভিএমেই, প্রয়োজন শুধু বাড়তি সতর্কতার
নির্বাচন কমিশনের ‘ভোটার ভেরিফায়েবেল পেপার অডিট ট্রায়াল’ বা ভিভিপ্যাট মেশিনের ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ইভিএম বিতর্ককে ফের প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। সাম্প্রতিক উপনির্বাচনগুলিতে শাসক পক্ষ জোরালো ধাক্কা খাওয়ার পর আত্মবিশ্বাসী বিরোধী শিবির। বিরোধী নেতাদের অনেকেই ব্যালট পেপারে ভোট গ্রহণের দাবি তুলেছেন। নির্বাচন কমিশন যখন নিজের মতো করে বর্তমান ভোট গ্রহণ ব্যবস্থাকে সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করছে সেই প্রেক্ষাপটে বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্র নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হওয়ার বিষয়টা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
স্বীকার করছি, ইভিএম বিতর্কের ক্ষেত্রে বন্ধু ও সহকর্মী মহলে আমি আক্ষরিক অর্থেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছি। যাঁদের সাথেই এ বিষয়ে আলোচনা করেছি তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই ইভিএম নিয়ে আপত্তি রয়েছে। তাঁদের ধারণা ক্ষমতায় আসার প্রথম তিন বছরের মধ্যে বিজেপি যেসব নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত সাফল্য পেয়েছে তা ইভিএমে কারচুপি ছাড়া সম্ভব ছিল না। আগামী লোকসভা ভোটেও সেই কৌশলেই শাসক দল জয়ের রাস্তা মসৃণ করতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা। তাই বোধহয় ইভিএমহীন নির্বাচনের পক্ষে এত সওয়াল। ইভিএম নিয়ে আপত্তির তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অনেকেই বেশ জোরালো যুক্তি সাজিয়েছেন। তবে আমি তাঁদের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। একথা অস্বীকার করব না, ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে আমি যে পালটা যুক্তি সাজিয়েছি সেগুলি সবাই যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েই শুনেছেন। যদিও আমার বক্তব্য তাঁরা মেনে নিতে পারেননি। এজন্য অবশ্য তাঁদের দোষ দেওয়া যাবে না। আমিই হয়তো যুক্তিগুলি ওদের সামনে ঠিকভাবে তুলে ধরতে পারিনি। সেকারণেই বন্ধু প্রশান্ত ভূষণও আমার সঙ্গে একমত হননি। ইভিএম বিতর্কে যাঁরা আমার বিপরীত মেরুতে রয়েছেন তাঁদের আর একবার বোঝানোর চেষ্টা করছি।
যান্ত্রিক ভোটযন্ত্র ব্যবহারের বিপক্ষে তিনটি জোরালো যুক্তি রয়েছে। এক, ইভিএমে যে কারচুপি করা একেবারেই অসম্ভব এখনও সেকথা নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব নয়। দুই, মোদি-শা জুটি যে যেন-তেন-প্রকারেণ ভোটে জেতার চেষ্টা করবেন তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তাঁদের কাছ থেকে কোনোকিছুই অপ্রত্যাশিত নয়। তিন, নির্বাচন কমিশন শাসক দলের চাপকে কতটা উপেক্ষা করতে পারবে তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। এই বক্তব্যগুলিকে কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তবে এসব সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে অত্যাধুনিক ভোটযন্ত্রকে দূরে সরিয়ে সনাতন ব্যালট পেপারের যুগে ফিরে যাওয়াটা আমার কাছে কোনো সমাধান নয়।
লক্ষণীয় বিষয় হল, ইভিএম নিয়ে এখনও পর্যন্ত যে বিতর্ক হয়েছে তার বেশিরভাগই যান্ত্রিক ভোটযন্ত্রের সম্ভাব্য অপব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ইভিএমের সমালোচকরা নানাভাবে বলার চেষ্টা করছেন এই যন্ত্রে কারচুপি করা সম্ভব। অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশন সহ ইভিএম সমর্থকরা তাঁদের মতো করে যুক্তি সাজিয়েছেন। ইভিএমকে হ্যক করা অসম্ভব এই হল তাঁদের বক্তব্যের সারবস্তু। তবে ইভিএম ব্যবহার করা উচিত কি উচিত না সেই বিতর্কে অযথা সময় নষ্ট না করে বাস্তব সমস্যার নিরিখে পদক্ষেপ করতে হবে। আমি কোনো যন্ত্র বিশেষজ্ঞ নই। আমার মতে, ইভিএমের কার্যকারিতা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ না করে আমাদের উচিত এই যন্ত্রকে আইনের আওতায় নিরাপদে ব্যবহার করার বিষয়টি নিশ্চিত করা।
ইভিএমের দুটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা জরুরি। প্রথমত, এই ধরনের যন্ত্রগুলি রিমোট সিগন্যাল গ্রহণ করে না। তাই ইভিএমের তথ্যে কারচুপি করতে হলে তা প্রতিটি যন্ত্রে আলাদা আলাদা ভাবে করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ইভিএমে যে চিপ লাগানো থাকে তাতে রাজনৈতিক দল, প্রতীক বা প্রার্থীদের নামের অধীনে ভোট নথিভুক্ত হয় না। ইভিএমে ভোট পড়ে প্রার্থীদের ক্রমতালিকার নম্বর অনুসারে। এই তালিকা তৈরি হয় সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের নামের হরফ অনুযায়ী। তাই এই যন্ত্রগুলিতে যদি গরমিল করতে হয় তবে তা করতে হবে প্রতিটি কেন্দ্রে কারা প্রার্থী হবেন তা নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর। শুধু তাই নয়, যে কেন্দ্রের ইভিএমে কারচুপি করা হবে সেখানকার বুথগুলিতে কোন ভোটযন্ত্রগুলি ব্যবহার করা হবে সেসম্পর্কেও আগে থেকে নির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। আর এই সব কাজের জন্য জালিয়াতদের হাতে খুব বেশি সময় থাকার কথা নয়। সাধারণত ভোট শুরু হওয়ার কম বেশি ৭২ ঘণ্টা আগে ভোট কেন্দ্রের জন্য ইভিএমগুলিকে নির্দিষ্ট করা হয়। তাই কেউ বৈদ্যুতিন ভোট যন্ত্রে গরমিল করতে চাইলে তাকে ভোট শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে প্রশাসনের যাবতীয় নজরদারিকে পাশ কাটিয়েই তা করতে হবে। সাম্প্রতিক ভোটগুলিতে কারচুপি করা হয়েছে প্রমাণ করতে হলে তথ্যপ্রমাণের প্রয়োজন। যদি অন্তত কয়েকটি ক্ষেত্রেও জালিয়াতি হয়েছে বলে প্রমাণ করতে হয় তাহলেও পারিপার্শ্বিক প্রমাণ সংগ্রহ করা জরুরি। তবে এখনও পর্যন্ত তেমন কিছু আমার নজরে আসেনি। আমার মতে, বিগত ভোটগুলিতে বিজেপির জয়কে শুধু কারচুপি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। অতীতেও বিভিন্ন ভোটে অপ্রত্যাশিত ফল লক্ষ করা গিয়েছে। বিজেপি যদি সত্যিই ভোটকে এভাবে প্রভাবিত করতে পারত তাহলে গুজরাট বা কর্ণাটকে তাদের ফল খারাপ হত না। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে কারা সাফল্য পেতে পারে তা জনমত সমীক্ষা থেকেই কিছুটা বোঝা গিয়েছে। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হল উত্তরপ্রদেশ। সেখানে বিজেপি যে এত বড়ো মাপের সাফল্য পাবে তা ধারণা করা যায়নি।
ইভিএম নিয়ে বিতর্ক অনেক পুরোনো। তবে ভিভিপ্যাট যুক্ত নতুন ধরনের যে ভোট যন্ত্রগুলি ব্যবহারের কথা ভাবা হয়েছে আশা করা যায় তা এই বিতর্কে ইতি টানতে সাহায্য করবে। নয়া ব্যবস্থায় ভোটদাতা কোন দলের প্রতীকে ভোট দিয়েছেন তা ছাপার কাগজে দেখে নেওয়ার সুযোগ পাবেন। নিজের ভোট সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি সেই কাগজ ‘ড্রপবক্স’-এ জমা দেবেন এরফলে পরবর্তীকালে ইভিএমে নথিভুক্ত তথ্যের সঙ্গে ড্রপবক্সে ফেলা কাগজের সংখ্যা মিলিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। এই ব্যবস্থাটি যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য সন্দেহ নেই। কারণ ভোটে ভিভিপ্যাট যুক্ত ইভিএম মেশিন ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে যান্ত্রিক গোলযোগ বা ধীরগতিতে ভোট নেওয়ার কথা জানা গেলেও জালিয়াতির অভিযোগ ওঠেনি। নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে যে পরবর্তী নির্বাচনগুলিতেও এভাবেই ভোট নেওয়া হবে।
তাই ইভিএম নিয়ে আতঙ্কে থাকা বন্ধুদের কাছে আমার অনুরোধ, ব্যালট পেপারে ভোটের দাবি তুলে নিজেদের শক্তিক্ষয় করবেন না। কারণ ব্যালটের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার সম্ভাবনা অনেক বেশি। বরং ভিভিপ্যাট যুক্ত ইভিএমের মাধ্যমে ভোটের আয়োজন যাতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে করা হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। এনিয়ে আমার কিছু প্রস্তাব রয়েছে।
এক, নির্বাচন কমিশনের উচিত বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ‘হ্যাকাথান চ্যালেঞ্জ’-এর ব্যবস্থা করা। যেখানে নথিভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলির মনোনীত বিশেষজ্ঞরা দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে ভিভিপ্যাট যুক্ত ইভিএম বেছে নিয়ে পরীক্ষা করার সুযোগ পাবেন। দুই, কোনো ভোটারের যদি সন্দেহ হয় তিনি যে দলকে ভোট দিয়েছেন তা ভিভিপ্যাটের প্রিন্টার থেকে বার হওয়া স্লিপের চেয়ে আলাদা, তবে তিনি যেন তখনই নিজের অভিযোগ নথিভুক্ত করার সুযোগ পান। কোনো একটি বুথ থেকে এই ধরনের ২০টি অভিযোগ জমা পড়লে বাধ্যতামূলক ভাবে সেখানকার ইভিএমে নথিভুক্ত ভোটের সঙ্গে ড্রপ বক্সে জমা হওয়া স্লিপ মিলিয়ে দেখতে হবে। এজন্য নির্বাচন বিধিতে সংশোধন আনা জরুরি। তিন, নতুন মেশিনে ভোট নেওয়ার পর কোনো অসঙ্গতি চোখে পড়লে ভোটাররা কোথায় কীভাবে অভিযোগ জানাবেন সেবিষয়ে ব্যাপক প্রচার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। কর্ণাটক বিধানসভা ভোটের সময় গুজব রটেছিল বিভিন্ন দলের পোলিং এজেন্টরা ভিভিপ্যাটের ভোটার স্লিপ দেখে কারা কাকে ভোট দিয়েছেন তা বুঝতে পারছেন। এরফলে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। এই ধরনের গুজবের বিরুদ্ধেও প্রচার জরুরি। চার, ভোট চলাকালিন কোনো ইভিএম সমস্যা দেখা দিলে যন্ত্রটিকে ৩০ মিনিটের মধ্যে বদলে দেওয়ার নিয়ম চালু করতে হবে। যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ইভিএম বদল করা সম্ভব না হয় তবে পুননির্বাচনের ব্যবস্থা করাতে হবে। এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে যত বেশি করে সচেতন করা যায় ততই ভালো।
এছাড়া গণনার সময় যে কোনো বুথের মধ্যে একটিকে তাৎক্ষণিকভাবে বেছে নিয়ে সেখানকার ইভিএমগুলির তথ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভিভিপ্যাটের মাধ্যমে পাওয়া স্লিপের তথ্য মিলিয়ে দেখতে হবে। যদি দুটি উৎস থেকে পাওয়া তথ্যের মধ্যে তফাৎ না থাকে তবে অন্যান্য ইভিএমের ভোট গণনা স্বাভাবিক নিয়মেই করা যেতে পারে। পাশাপাশি প্রার্থীদের মধ্যে যাঁরা ভোট প্রাপ্তির নিরিখে দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে থাকবেন তাঁদের নিজেদের পছন্দ মতো যে কোনো বুথের ইভিএম ও ড্রপ বক্সের কাগজের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য দ্বিতীয়বার মিলিয়ে দেখার দাবি জানানোর অধিকার দিতে হবে। সেই কাজ শেষ হওয়ার পরেই ওই কেন্দ্রের চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা যাবে।
এই ধরনের ব্যবস্থা নিতে গেলে গণনার সময় হয়তো ঘণ্টাখানেক বাড়াতে পারে। তবে এর মাধ্যমেই গণতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা আরও বাড়িয়ে তোলা সম্ভব। নির্বাচন এমন একটি বিষয় যা দেশের প্রতিটি মানুষকে প্রভাবিত করে। যাঁরা জয়ী হন তাঁদের কাছে ভোটের ফল যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনই পরাজিত পক্ষের কাছেও তা নানা কারণে গুরুত্ব পেয়ে থাকে। তাই এই ব্যবস্থায় অধিকতর স্বচ্ছতা আনা সম্ভব হলে তা সবার পক্ষেই মঙ্গলজনক হবে।
নিবেদনটি প্রথম প্রকাশ হয়: www.uttarbangasambad.in
Photo credit: Open Source
লেখক: যোগেন্দ্র যাদব
স্বরাজ ইন্ডিয়ার রাষ্ট্রীয় অধ্যক্ষ
লেখকের মতামত বেক্তিগত